Total Pageviews

Saturday 24 September 2011

'বনাম' চয়নের বাহির? দেবপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়

দেবপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়
বেচারা রাষ্ট্র যে আজ বিপন্ন, আক্রান্ত, বিপর্যস্ত তা আমরা কেউ ঠিক বুঝতে চাইছি না, বুঝতে পারছি না। অন্য কল্পিত নেশনের রাজনৈতিক ভূগোলের সঙ্গে সংঘাত লাগু আছে বলে তাকে বিপুল ব্যায়বহুল সামরিক আয়োজন করতে হয়, এমন কি নিজের সীমানার মধ্যেও "টেররিষ্ট'দের মোকাবিলা করতেও অস্তরশস্তর সাজাতে হয়, নজরদারি বন্দোবস্ত বাড়াতে হয়। আমার মত সাধারণ রাষ্ট্রীয় নাগরিক মেট্রো থেকে এয়ারপোর্টের অন্দর অব্দি ঘুষতে গেলেও আগাপাশতলা সার্চ করিয়ে নিতে হয়। এসব করতে কি সরকার বাহাদুরের কম হ্যাপা?

তেমনি আবার গণতান্ত্রিক সরকার বানাতে গেলে "ভোট' করতে হয়। সেও বড়ো খরচার ব্যাপার। তার ওপর রাষ্ট্রেরই অন্যতম অঙ্গ, বেশীর ভাগ জনগণ ভোট বিমুখ। এটা টার্ন- আউটের পরিসংখ্যান দেখলেই বোঝা যায়। না, পরিসংখ্যান দেওয়ারও দরকার নেই, ভোট দেওয়ার বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে যখন, তখন বোঝাই যায় বিমুখ ভোটারকে বুথ-সমুখ করার জন্যই বিজ্ঞাপন দিতে হচ্ছে বাধ্য হয়েই। নিত্যপ্রয়োজনের তালিকার মধ্যে যা আছে, এই আলো- জল- বাতাস-রোটি- কাপড়া- মকান ইত্যাদি যখন বিজ্ঞাপিত হয়, তখন বুঝে নিতে হবে যে এসবের আক্রা পড়েছে বা কারোর মালিকানাধীন হয়ে গেছে। রাষ্ট্র নেহাতই "বিপন্ন' হয়ে বিজ্ঞাপন করছেন।

ভোটের অনুরোধে রাষ্ট্রাঙ্গ সরকার যখন বিজ্ঞাপন করেন বা রেজিষ্টার্ড পার্টি করেন প্রচার (মানেই তো বিজ্ঞাপন!)তখন তো প্রশ্নই করতে হয় যে: নির্বাচন কি আমাদের নিত্যপ্রয়োজনের মধ্যে পড়ে না? এর কি ব্যাবহারিক মূল্য উবে গিয়ে বিনিময় মূল্যের অধীন হয়ে পড়েছে, মানে দেনা- পাওনার সম্পর্কে পরিণত হয়েছে?

ইউনিভার্সাল ফ্র্যানচাইজি ব্যাপারটা মহাকালের নিরিখে খুব বেশী দিনের নয়। ১৭৯২ তে ফ্রান্সে এর আবির্ভাব। তাও মেয়েরা বিভিন্ন দেশে ভোট দিতে পারতেন না, যেমন এখন বাচ্চারা পারেন না। বাচ্চাদের ভোট দেওয়া নিয়ে ঝগড়াঝাঁটিও আছে। বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন নিয়ম। এমনকি এই দাবীও উঠেছে যে,কিশোর(রী)-দের গাড়ী চালানো বা শৃঙ্গারের "বিপজ্জনক' (!) কেন ভোটাধিকার থাকবে না?

আবার সাদা- কালোর জাতপাতের নিরিখে ভোটদান অধিকার নিয়ে সমস্যা ছিল। সে সব পেরিয়ে এখন যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, তা এক কথায় বললে বলা যায়: এই নির্বাচন বিনিময় মূল্যের অধীন হয়ে গেছে; অর্থাৎ পণ্যে পরিণত হয়েছে।

এই ভোটের পণ্যায়ন বোঝা যায় একটা চালু শব্দ থেকেঃ ডলার ভোট! সংখ্যালঘু অতিধনীর আরামকেদারায় ভোট ইণ্ডাষ্ট্রির হিসেব নিকেশ হয়ে যায়।তাঁরাই নাকি আজকাল ঠিক করে নেন জেতা হারা হিসেব। ভোট ইণ্ডাষ্ট্রিতে তাঁরা সরকার গঠনকারী পার্টির কাছ থেকে তুলে নেন। তাঁদের অন্য নানান বেওসা চালাতে গেলে যে সরকারী অনুমোদন লাগে, তা বিরোধী ও শাসকদলের হোমরাচোমড়াদের কাছ থেকে তাঁরা পূর্ব কৃতজ্ঞতার কাছ থেকে তাঁরা পূর্ব কৃতজ্ঞতার মূলে আদায় করে নেন। তাই ভোট মানে ডলারের বিনিময়ে ভোট। "ডলার' কথাটা আবার সামচাচার দেশের আধিপত্যকে চিহ্নিত করে দেয়। "চিহ্নিত' কথাটার অনুষঙ্গে বলে ফেলাই যায় "টাকা-চিহ্ন' শব্দ বন্ধটাঃ টাকা নামের চিহ্ন বা রূপকটা দুটো অসমান জিনিসকে সমান করে দেয় তো!! একটা আইসক্রীম আর দশ টাকা কি "ইজ ইকুয়াল টু' দিয়ে কি লেখা যায়?

আরো ভোটের পণ্যায়ণ খেয়াল করুন। এই পার্টির নেতা- নেত্রীরা কেমন অসহায় হয়ে বলছেন আমজনতাকে- "তোমাকে এই দেবো, সেই দেবো'। করুণানিধি ল্যাপটপ দিতে চাইলে, জয়ললিতা গরু ছাগল থেকে গরীব বড়লোক নির্বিশেষে বিশকিলো চাল হরমাস মাগনা দেবেন বলেছেন। এই প্রতিশ্র¦তির মধ্যেও অতিধনী বা ডলারের দাপট আছে।

তাই একদল রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে, এমন পণ্যায়িত গণতন্ত্রে যে জেতে, সে আসলে সংখ্যালঘু অতিধনী। সংখ্যাগুরু আমজনতার জয় নয়, খাস ইনসানের জয়। কেন না আমজনতার কনসেপ্ট বিজ্ঞাপনের কারিকুরিতে ম্যানুফ্যাক্চার্ড হয়।

এই সংখ্যালঘুর জয়ের হিসেব অন্যভাবেও করা যায়। বিগত বিশবছরের বিভিন্ন নির্বাচনের ভোটদান একটু সাদামাটা ভাবেই করি। ধরা যাক, একটি ভোটকেন্দ্রে বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে জনসংখ্যা একশো (১০০)। এর মধ্যে ৩০ জন বাচ্চা বাদ গেল, রইল পড়ে ৭০! এই ৭০ জনের মধ্যে ভোট দিতে যাচ্ছেন কমকোরে ৬০%, মানে ৪২ জন। এবার এই ৪২ জনের ভোট ভাগাভাগি হবে মূল দুই বা তিন পার্টির সঙ্গে গোঁজ (প্রক্সি বা ডামি প্রার্থী, সব রাজনৈতিক দলই ভোট কাটার জন্য এঁদের গোঁজেন) প্রার্থীর। বিয়াল্লিশ (৪২) জনের মধ্যে ৩% চলে গেল গোঁজে! ধরে নিচ্ছি আগেকার "সায়েন্টিফিক রিগিং' এর দৌলতে আরও শতকরা তিন ৩% অবৈধ ভোট। ৪২- এর ৬%, একুনে ২.৫২% বাদ পড়ে গেলেন। এবার আসছে ভুল বা ক্যানসেলড ব্যালটের ৪%, মানে ১.৬৮ জন (এই হিসেব অবশ্য ইভিএমের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, এটা গোঁজে চলে যাবে)। কাজের সুবিধের জন্য বিয়াল্লিশ (৪২) থেকে চার (৪)জন বাদ দিলুম, পড়ে রইলেন ৩৮। এই ৩৮-এর ৪০% (কম করে) ভোট যিনি পাবেন মানে মোটামুটি ১৬ জনের ভোট তার তো জয়জয়কার? তার মানে, ৮৪ জনের মতামত সংসদ নামক "শুয়োরের খোঁয়াড়' (লেনিন) বা "বন্ধ্যা বা বেশ্যা' (গাঁধীজির মত ভদ্দরলোক, এমন কথাই কয়েছেন!) পরিসর থেকে বাদ পড়ে গেল।

এটা একটা গোদা হিসেব- সংখ্যালঘুর ডলার বিতরণী জয়ের হিসেব। তাই, কেউ কেউ মনে করছেন, দরকার নেই বাপু- এমন তিলকে তাল করে পয়হা নষ্ট করার!! আর সংখ্যালঘু অতিধনী যখন আগেই ঠিক করে রেখেছেন, ডলার দিয়ে কোনো পার্টিকে জেতাবেন, তা হলে আর ইয়ের এপিঠ ওপিঠ -এর বনাম বাইনারি (দুইয়ের লড়াই, এখানে দুইয়ের মধ্যে আবার কোনো গুণগত অমিল নেই) নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন কি? ইভিএমে একটা "ক্যানসেলড' বোতাম দিয়ে দিয়ে দাও না বাবা! পার্টির লোকেরা বড্ডো জ্বালাতন-পোড়াতন করে ভোটের দিনঃ "ভোট দিতে চলুন- এটা আপনার অধিকার!' আরে নিকুচি করেছি অধিকারের!!! সরকার বাহাদুর আমার অন্য অনেক অধিকার দেন না, তা পেতে গেলে দীর্ঘমেয়াদী মামলা মোকোদ্দমা করতে হয়, আর এই তো ভোটের অবস্থা!!! তার থেকে "বাতিল' বোতাম টিপে আসি চুপচাপ। পার্টি করা ছেলেপিলে বা মেয়েরা বিপদের দিনে পাশে এসে দাঁড়াবে।

খেয়াল করে দেখুন, আমি পার্টি নামক এক "লিমিটেড কোম্পানি' বা কর্পোরেট সংস্থার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি! এই পরিসরটার নাম- পাবলিকের পলিটিক্যাল সোসাইটি। আমার প্রাইভেট পরিসর (পরিবার, ক্লাব, বিদ্যাসত্র) পাবলিক বা পলিটিক্যাল হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, কেমন পলিটিক্যাল? আমার সামনে নেতাদের মলিন স্থাপত্য নীতিহীন রাজনীতিকে চিনিয়ে দিয়েছে। সামনে কোনো অমলিন ভাস্কর্য নেই। তা হলে, এমন গণতন্ত্রকে আমি টা টা- বাই বাই করবো? গণতন্ত্রে আস্থা রাখব না?

মোটেই না! বরং সেই ছোট্ট পরিসরে "গণতন্ত্র' অভ্যাস করার প্রয়াস চালাব। কেননা, এটা দৈনিক নিরন্তর প্রক্রিয়া। পুং আমি কি আমার পরিবারের মধ্যে, আপিসের মধ্যে,ক্লাবের মধ্যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু রাখি? এসব জায়গায় অনবরত "বসিং' করি না আমি? গণতন্ত্র "সাধনীয়' এক প্রক্রিয়া, দু একদিনের মোচ্ছব নয়!!!!! আগেই বলেছি- এই সেদিন তার জন্ম- একে প্র্যাকটিস করতে হবে, সাধনীয় প্রক্রিয়ায় নিয়ে যেতে হবে। ছোটো ছোটো বিকেন্দ্রিক এলাকায় গণতন্ত্রের আনুভূমিক পরস্পর নির্ভর সহযোগিতা বানিয়ে তুলতে হবে- মাস্তানি ছেড়ে-। ছোটো এই বিকেন্দ্রে মাস্তানির সম্ভাবনা থেকেই যায় তো! এটাকেই কি তবে "বদল' কইব? এবারের ভোটে হয়তো "ক্ষমতার হস্তান্তর' হবে,বদল বা মৌলিক পরিবর্তন কিছু হবে না। পঁয়ত্রিশ বছর(বাহাত্তর থেকে ধরলে,উনচল্লিশ বছর) হাঁফ ধরা অবস্থায় ছিল, কথা কইতে ভয় হতো, তার থেকে হয়তো খানিক "মুক্তি' ঘটবে, কিন্তু "মৌলিক' কোনো বদলের আশা করি না।

কেন করি না? এটা কি আমার "ব্যক্তিগত' মত? আজ্ঞে না! আমি পরের ধনে পোদ্দারি করি, বহু মানুষ বাড়তি পরিশ্রম দিয়ে আমায় খাদ্য-বস্ত্র জোগান দেয়, আমার বাড়ি তৈরী করে দেয়। এগুলো করার দক্ষতা, আমার ইস্কুল- কলেজীয় শিক্ষা আমায় দেয় নি। আমি পরজীবী, আমার আবার ব্যক্তিগত মত কি? অসংখ্য মানুষের রক্তঘাম ঝরা ক্লেদের ওপর দাঁড়িয়ে আছি আমি (আহারে! দরদ উথলে উথলে উঠছে!)। আমার নিত্য প্রয়োজনকে যদি আমি নিজেই নির্মাণ করতে পারি (এটা করতে আমার দৈনিক আড়াই তিন ঘন্টা সময় লাগবে) এবং শিশু-বুড়ো-প্রতিবন্ধীদের জন্য শ্রমব্যায় করতে পারি, তা হলে টাকা-চিহ্ন /রূপকের ওপর নির্ভর করতে হয় না আর। কর্মসংস্থানের গপ্পোটাও হাওয়া হয়ে যায়। আমার মত চাকুরিজীবী বা চাষাভুষো-তাঁতিদের অনিচ্ছুক বাড়তি শ্রমদান, তা হলে ইচ্ছুক সহর্ষ শ্রমদানে পরিণত হবে।

আপনারা আমার এই ইউটোপিয়ান চিন্তায় ফ্যাক করে হেসে ফেলে, আমায় শ্রমবিভাজনের কথা শোনাতেই পারেন! কিন্তু, আমি বলব শিল্প পরবর্তী বিগত আড়াইশো বছরে, বাড়তি শ্রম ঝাড়ার মত অনৈতিক কাজ শুধু ঘটে নি, নিসর্গ বিদ্ধস্ত হয়েছে এবং হতে চলেছে। এমন প্রলয়ের মুখে দাঁড়িয়ে বলতেই হচ্ছে, টাকা নির্ভর দেনা পাওনার আর্থ-রাজনীতি ও নিসর্গ নাশক ইণ্ডাষ্ট্রির স্পেশালাইজেশন বাতিল করে, কিপটেমির অর্থ-নীতি ( Economics of Austerity ) বিকেন্দ্রীকৃত পারটিসিপেটারী গণতন্ত্রে ফিরে যেতেই হবে।

সেখানে ব্যক্তিগত মালিকানার পাপ থাকবেই না। এ পৃথিবীর একাংশের মালিক তো আমি কিছুতেই নই, নেশন বা রাষ্ট্রও নয়, আমরা আপাত-দখলদার মাত্র ( Occupant )। ব্যক্তিগত মালিকানা না থাকলে, সময় আয়োজনও লাগবে না। আবার দুই মতের "বনাম' নিয়ে কাজিয়া না করে সমস্ত মানুষ আর না-মানুষের ভেদ( Difference )ও অভেদ ( Identity ) কে ধৈর্যের সঙ্গে শুনে, ছলনাহীন সংলাপেও মাততে পারব। এ ব্যাপারে আমায়, কবীর- দাদূ- লালনের মতো তাঁতি-মুচি-জোলা-চাষাভুষোরা (আম, তাঁরা!!! খাস V.I.P. নন) ডেমন মদত দেবেন, তেমনি সঙ্গে থাকবেন Poet and Plowman (sic) রবি ঠাকুর বা গাঁধীর মত নড়বড়ে মানুষ এবং অবশ্যই- কার্ল মার্কস, বাকুনিন, ক্রোপটকিন ...। আর দৈনিক গড়পড়তা আড়াই ঘন্টা পরিশ্রম করে নিজের খাবার-পোষাক যদি বানাতে পারি, তাহলে তারপর নিজের খুশীতে সেতার বাজাতে পারি বা ভালো বই পড়তে পারি বা কোমরে কোমর মিলিয়ে নাচতে পারি অথবা কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা করতে পারি। ...

এই ইউটোপিয়া (আদতে হেটেরোপিয়া বা অনেক ইউটোপিয়া) সহজে সমঝে যেতে চান? তা হলে, প্রেমেন মিত্তির আর লীলা মজুমদারের যৌথ ভাবে লেখা ""হট'টমালার দেশে' গপ্পোটা পড়ে ফেলে, বাদল সরকারের নাট্য রূপান্তর দেখে/পড়ে নিতে পারেন।

"বাইনারি' বনাম নির্বাচনী প্রহসনের ব্যয়বহুল বন্দোবস্তের কোনো "বাহির ( Outside ) নেই'-এমন কথাটা যখন মনের মধ্যে গেঁড়ে গেছে তখন আমার এমন কাঁচা লেখার থেকে অমন অসাধারণ গপ্পো -নাটক আপনাদের "বাহির' দেখিয়ে দেবে, সহিষ্ণুতার রাজ-নীতিতে দীক্ষা দেবে। রাষ্ট্রের বিপন্নতা, তাতে বাড়বে বই কমবে না।


("একদিন '-এ পূর্বপ্রকাশিত)

No comments:

Post a Comment

Note: only a member of this blog may post a comment.